দুপুর তখন ১টা ২০ মিনিট। চোখে হঠাৎই ভেসে উঠলো এক মারাত্মক খবরের ঝলক "মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত! থমকে গেল মন, কেঁপে উঠলো হৃদয়। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, চোখে পড়লো নামগুলো, স্কুলের পরিচিত জায়গা, উত্তরা, যেখানে প্রতিদিন হাজারো শিশু তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন আঁকে, সেখানে আজ শোকের ছায়া। আমি আর সময় নষ্ট করিনি। অফিস ফেলে দিয়ে রওনা হলাম মাইলস্টোন স্কুলের দিকে। প্রতিটা সেকেন্ডে বুক ধড়ফড় করছিল। যেন নিজেরই সন্তান কেউ, যেন নিজের রক্ত মাংসের কেউ সেখানে আটকে আছে।
আমি গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দিলাম ভিতরের দিকে। পৌঁছে যা দেখলাম, তা যেন কোনো দুঃস্বপ্ন, যা কল্পনায়ও আসে না। পুরো এলাকা এলোমেলো, ধোঁয়ার গন্ধ, আগুনের তাপ, কান্না আর আতঙ্কের শব্দে ভরে গেছে চারপাশ। একটি প্রশিক্ষণ বিমান, যেটি শুধু আকাশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা, সেটি কীভাবে স্কুলের গা ঘেঁষে ভেঙে পড়ে? কে অনুমতি দেয় জনবহুল এলাকায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ চালানোর? কে নেবে এই শিশুর মৃত্যুর দায়?
চারপাশে রক্তাক্ত দেহ, কাঁদতে থাকা অভিভাবক, মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাত্রছাত্রী, কেউবা নিথর পড়ে আছে, কেউবা কাতরাচ্ছে। অথচ অনেকেই মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছে। এই লজ্জা কার? মানুষের মানবতা হারিয়ে গেল কবে? আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। পাথরের মতো শক্ত করে নিজেকে গড়ে তুললাম, উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
প্রতিটি আহত দেহ, প্রতিটি আর্তনাদ আমার মনকে যেন চিরে চিরে ছিঁড়ে ফেলছিল। একেকজন বাচ্চা যখন ‘মা’ বলে চিৎকার করছিল, তখন বুকটা থেমে যাচ্ছিল। আমি পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম, যেন চোখে পানি আসে না, অথচ বুকের ভেতর ঝড় চলছে।
এই দুর্ঘটনা যদি স্কুল ছুটির পর অর্থাৎ ৩টা নাগাদ ঘটতো, তাহলে পরিস্থিতি হয়তো একটু সহনীয় হতো। ঘটনার সময় অনেক অভিভাবকই ছিলো স্কুলের বাইরে অপেক্ষায়। কিন্তু এই সময়টাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর,ছুটি হওয়ার মুহূর্তে, যখন বাচ্চারা বের হচ্ছিল, কেউ রাস্তা পার হচ্ছিল, কেউ গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়লো।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবন কতটা অমূল্য হয়ে গেছে, এই ঘটনা যেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। প্রতিদিন আমরা কোনো না কোনো দুর্ঘটনার খবর শুনি-নৌকাডুবি, ভবন ধস, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, গুম, হত্যা-সবকিছুতেই সাধারণ মানুষ মরছে। এই রাষ্ট্র কি শুধুই মৃতদেহ গুনে যাবে? কোনো প্রতিরোধ নেই? কোনো জবাবদিহিতা নেই?
মাইলস্টোন স্কুলের এই ঘটনাটিকে আমরা একটি দুর্ঘটনা বলে পাশ কাটাতে পারি না। এটা একটা ভয়ঙ্কর অব্যবস্থাপনার চিত্র। যেখানে জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলতে পারে, সেখানে শুধু নিরাপত্তার প্রশ্নই নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতারও প্রশ্ন উঠে যায়। শিশুদের স্কুলেও যদি নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে আমরা কোথায় নিরাপদ? একজন অভিভাবক তার সন্তানের হাত ধরে স্কুলে দিয়ে আসে এই আশায় যে সে শিখে বাড়ি ফিরে আসবে, অথচ ফিরে আসে তার নিথর দেহ!
প্রশ্ন আসে, কর্তৃপক্ষ কি জানত না এটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা? স্কুল-কলেজ, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ঘেঁষে কেন প্রশিক্ষণ বিমান উড়বে? এর জন্য কোনো বিশেষ আইন নেই? থাকলে তার বাস্তবায়ন কোথায়? রাষ্ট্র কি শুধু স্যোসাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড দেখেই নড়ে উঠে? আগে থেকে কিছুই করা যাবে না?
এ ঘটনা যেন বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়-আমরা কেউই নিরাপদ নই। না স্কুলে, না রাস্তায়, না নদীতে, না ট্রেনে, না বাড়িতে। রাষ্ট্র যখন শুধুই প্রতিক্রিয়াশীল হয়, প্রতিকারের বদলে প্রতিদিন লাশ গোনে, তখন মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমরা কবে proactive হবো? কবে বলবো—"Enough is enough"?
এই যে শিশুর মৃত্যু, শিক্ষার্থীদের আহত হওয়া, অভিভাবকদের বুকফাটা কান্না-এগুলো কি শুধু সংবাদে শিরোনাম হয়ে থাকবে? নাকি এগুলো থেকে কিছু শিখবো? এই বিমান দুর্ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি হয়তো গঠিত হবে, রিপোর্ট জমা পড়বে, দায় এড়াতে বলা হবে "টেকনিক্যাল ফল্ট", অথবা "পাইলট ভুল করেছে"। কিন্তু যারা সন্তান হারালো, তারা কি আর কখনো শান্তিতে ঘুমাতে পারবে?
আমাদের রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এখনই। আমরা যদি এখন না জাগি, তাহলে কাল হয়তো আমার-আপনার সন্তানের লাশ কাঁধে তুলতে হবে।
দয়া করে রাষ্ট্র, আর চুপ থাকবেন না। নিরাপত্তা শুধু রাষ্ট্রীয় অতিথিদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষেরও আছে বেঁচে থাকার অধিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তা, পরিবহন ব্যবস্থা-সব জায়গায় প্রয়োজন সুরক্ষা, নজরদারি, নীতিগত জবাবদিহিতা। আজকের এই দুর্ঘটনাকে ইতিহাসে শুধু আরেকটি সংখ্যা না বানিয়ে, এটা থেকেই যেন শুরু হয় নিরাপত্তার এক নতুন অধ্যায়।
আজ আমার চোখে ঘুম নেই। কান্না আমার গলায় আটকে আছে। আমি কাঁদি না, তবু বুকের মধ্যে এক অনন্ত বেদনার স্রোত বইছে। প্রতিবার চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠছে সেই ছিন্নভিন্ন মুখগুলো, সেই কান্নার শব্দ, সেই রক্তমাখা কাপড়, সেই থমকে যাওয়া স্কুলগেট। এই দেশে শুধু জন্মলাভ করলেই দায়িত্ব শেষ নয়-এই দেশকে নিরাপদ রাখতে হলে আমাদের এখনই জেগে উঠতে হবে।
তবে এই বিভীষিকাময় মুহূর্তে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রশংসনীয় দ্রুততায় উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ঘটনাস্থল ঘিরে রাখার মধ্য দিয়ে তারা দেখিয়েছেন দক্ষতা ও মানবিকতা। যদিও উৎসুক জনতার অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ের কারণে উদ্ধার কার্যক্রমে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল, তবুও বাহিনীগুলো পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। তাদের এই তৎপরতা না থাকলে হয়তো আরও প্রাণহানি হতো।
এদেশে আর কোনো শিশু যেন স্কুল থেকে লাশ হয়ে বাড়ি না ফেরে, এই হোক আমাদের প্রত্যয়।
আমার বার্তা/এমই