আমাদের দেশের শিক্ষা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর। এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পাস ও ফেল। পাস যারা করছে তারা তো হাতে চাঁদ পেয়েছে আর যারা পাস করতে পারছে না তারা অন্ধকারের কোণায় অন্তত কয়েকটা দিন কাটাবে। একজন শিক্ষার্থী প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির টেষ্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারপর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এখন শুধু এসএসসি পরীক্ষায় কোনো কারণে অকৃতকার্য বা ফেল করলেই তার পিছনের পাসের ইতিহাসগুলো মুছে যাবে। কি আশ্চর্য ধরাবাধা নিয়ম! সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। কোন বোর্ডে কতজন পাস করলো সেটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশ ফেলের হিসাব নেওয়া হচ্ছে। পাসের হার ছেলে না মেয়েদের বেশি তাও নির্ণয় করা হয়েছে। সার্বিকভাবে পাসের হার কমে এসেছে। ১৩৪টি প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর তুলনায় শিক্ষক বেশি রয়েছেন! সেখানেও কাউকে পাস করাতে পারেননি সেসব শিক্ষকরা! প্রশ্ন হলো এসব ছাত্রছাত্রী বিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেখে সরকারের লাভটা কি হচ্ছে? মাসে মাসে বিপুল অংকের টাকা খরচ হচ্ছে বেতন-ভাতায়। অথচ প্রতিষ্ঠানের আয় ভাড়ে মা ভবানী! যাও বা দু’চারটা ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করে তারাও পাস করতে পারে না। রাষ্ট্রের এই অপচয়ের পিছনে রহস্য জানতে ইচ্ছে করে! অথচ কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে সত্যিই শিক্ষকের দরকার। অথচ সেখানে শিক্ষক সংকট। যাই হোক, ফেল করে সামাজিক অবস্থায় তাদের লজ্জাস্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ফেল করে আত্নহত্যার খবরও আসছে। গোল্ডেন জিপিএ নামক কোনো ফল না থাকলেও অনেক অভিভাবককে বলতে শুনলাম তার সন্তান গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে! শুধু জিপিএ বলতে তাদের সম্ভবত লজ্জা করছে! নিজের মূর্খতা এভাবেই প্রকাশ করছেন তারা। আর যাদের সন্তান পাস করতে পারেনি তারা চুপচাপ। কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন।
বিগত দশ বছরের পাসের কোনো মূল্যই আমরা দিতে পারছি না। এভাবে গড়ে উঠেছে পুরো সিস্টেম। পাস করলেই মিষ্টি কেনো! এক ছাত্র তো আবার আই ফোনও চেয়ে বসেছে! পাসের যে এত মহিমা আগে জানা ছিল না। বিষ্ময়কর ব্যাপার! জিপিএ ফাইভ না পেলেই আত্নহত্যা করতে হবে? কিন্তু কেন? আত্নহত্যা কেন? একবার ফেল বা জিপিএ ফাইভ না পেলেই কি জীবনের সব শেষ হয়ে যায়? এত তুচ্ছ এ জীবন। যারা পাস করতে পারেনি তাদের প্রতি আমার তেমন মন খারাপ নেই। এটা ঠিক যে পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল একটা ভাল্ োফলাফল করা। সেটা না হলে মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু তার থেকেও আমার মনে আশংকা থাকে প্রায় প্রতিবারই এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর কারও কারও আত্নহননের খবর পত্রিকায় পড়তে হয়। এটা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক। জীবনটা তো অনেক বড়। সমস্যাটা হলো ফল প্রকাশের পর অনেক অভিভাবকও সহানুভূতি স¤পূর্ণ আচরণ করে না বলেই আমার মনে হয়। এমনকি তার প্রতিবেশি ও আত্নীয় স্বজনদের কাছ থেকেও তার জন্য বিরূপ আচরণ হয়ে থাকে। এ বছর ছয় লাখেরও বেশি ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে। পাসের হারও অনেক কমে এসেছে। ফাউ নম্বর না দেওয়া এর একটি অন্যতম কারণ। এর অর্থ এত বছর অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকের যোগ্যতায় পাস করেছে! নিজের যোগ্যতায় নয়। কতজন বা তারা কারা সেটি আর নির্ধারণ করার উপায় নেই। কারণ তারা তো প্রকৃত পাসযোগ্য ছিল না। অথচ এরা এখন উচ্চ শিক্ষিত! এদের দিয়ে দেশের কি উপকার হবে কে জানে! এই লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী ফেল নিয়ে কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আমি ভাবছি এখানে উদ্বেগটা কম। আমরা এতদিন যে স্কুলকে বা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ঠিকঠাক বলে জানতাম এবার কিন্তু বেরিয়ে এসেছে অন্য তথ। পাসের হার বৃদ্ধি করতে এবার থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা যে খুব কঠিন বিষয় তা নয়। পাসের হার যে এক লাফে আগের মতো করতে হবে সে কথাও তো কেউ বলছে না। অন্তত শতকরা ৮০ হলেই চলবে। সেটা খুব একটা কঠিন হবে না। প্রথমে ঘাটতি চিহ্নিত করতে হবে। এই যে গণিত বিষয়কে দায়ী করা হচ্ছে সেখানে ফোকাস করতে হবে। গণিত শিক্ষকদের ঘাটতি সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। কোন পদ্ধতিতে শেখানো হচ্ছে বা আদৌ ক্লাসে ঠিকঠাক গণিত শেখানো হচ্ছে কি না সেটিও বের করা দরকার। নাকি শিক্ষক মহোদয়রা কেবল প্রাইভেট আর কোচিং নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন সেটির খোঁজ নেওয়া জরুরি। গণিতকে কঠিন করে তুলছেন কিন্তু এই শিক্ষকরাই। আবার সহজও করছেন তারা। গণিতকে কিভাবে আরও সাবলীল করে তোলা যায় তার কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ন করতে হবে। সাথে ইংরেজির ঘাটতিও দূর করতে হবে।
আমরা প্রতিযোগীতার নামে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগীতা তৈরি করেছি। প্রতিযোগীতা ভালো। তবে তা জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই নয়। ফল খারাপ হয়েছে তবে ভালো করার সুযোগও তো আছে। কোথাও কোথাও লেখা হয়েছে ফল বিপর্যয়। একদিক থেকে ধরলে এটা ফল বিপর্যয়ই বটে। হঠাৎ এই প্রকৃত ফল অনেকের চোখেই বেশ খারাপ লাগছে। অথচ যখন হঠাৎ ফল উর্ধ্বগামী হয়েছিল, এ প্লাসের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল তখন তো এত প্রশ্ন আসেনি। যাও বা এসেছে ব্যক্তিগতভাবে কিন্তু এভাবে নয়। এভারের ফলকে কোথাও কোথাও মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থী যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে একটুও আফসোস নেই। কারণ কয়েকজন নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে একজন প্রকৃত মেধাবী দরকার। কারণ সেই একজন বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তাই পাসের হারের কারণে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলেই মনে হয়। লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত বেকার তৈরির চেয়ে এটা অনেক বেশি কার্যকর। সফলতা এবং ব্যর্থতা- জীবনের এই দুটি দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকা উচিত। এ প্লাস প্রাপ্তদের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা বেশিরভাগের চোখেই ছিল সন্দেহের দৃষ্টিতে। তাই এ পরিবর্তনটা জরুরী ছিল। এ প্লাস শিক্ষার্থীদের সেই আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ মার্কা আলোচনা সমালোচনা আজও মনে আছে। সত্যি কথা বলতে এইসব শিক্ষার্থীকে আমি কমই দোষারপ করি। ভিত্তি যদি দুর্বল হয় তাহলে উপরের অংশ নরবড়ে হবেই। দেশের ঘটনাবহুল ইতিহাস সঠিক কতজন শিক্ষার্থী বলতে পারবে? যদিও প্রাথমিক থেকেই তাদের জানার কথা। কিন্তু আদৌ সবাই জানে কি? আমাদের জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সব শিক্ষার্থী জানে কি? বইয়ের বাইরে এমনকি বইয়ের থেকেও এরা আসলে বেশি শিখছে না। এদের প্রকৃত মনোযোগ অন্য কোথাও। সেই কারণে প্রচুর পাস করাতে হবে, পার্সেন্ট বাড়াতে হবে এই অশুভ চিন্তা পরিহার করার সময় এসে গেছে।
পরীক্ষা মানে পাশ আর ফেল। যারা পাশ করছে তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাশ করছে না তারা কি মেধা শূণ্য? কোন একটা বা দুইটা বিষয়ে ফেল করলেই কি তার মেধা নেই বলা যেতে পারে? শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোন ছাত্রছাত্রীর মেধা পরীক্ষা করা যায় না। কারণ স্কুল কলেজের পাশ ফেল শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ হয়ে পরবর্তী জীবনে বড় বড় ব্যাক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। এবং এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। অনেক দূরের উদাহরণ না দিই। আমাদের দেশেই মাঝে মধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় কোনো গ্যারেজের মিস্ত্রী বা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী অথবা কোনো ডিপ্লোমা পাস ছাত্র কোনো গাড়ি বা হেলিকপ্টার তৈরি করেছেন। সেসব দিয়ে তারা রাস্তায় চালাচ্ছেনও। মাঝে মধ্যেই কিন্তু এসব খবর আমরা পাই। অথচ দেখবেন এই যে আমরা প্রযুক্তিতে যাদের সবচেয়ে মেধাবী বলছি সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে দেশে থেকে কয়টি গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কার তারা করতে পেরেছেন? দেশকে তারা কি দিয়েছেন? যদি তাই হতো তাহলে স্বাধীনতার পর থেকে এই এত বছরে আমরা নাম করা দু’একজন বিজ্ঞানী পেতাম! তাহলে পাশ ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও সর্ম্পূন নির্ভর নয়। আর ফেল করার দায় কিন্তু একা ছাত্রছাত্রীর কাঁধে বর্তায় না। শিক্ষকও এর জন্য সমান দায়ী। আর এর জন্য পুরো সিস্টেমটাই দায়ী। কারণ কেবল গণিত খারাপ করলেই সে খারাপ ছাত্রের কাতারে চলে গেলো! এই শিক্ষা নিয়ে ঠিক কতদূর পৌছানো সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।
আমার বার্তা/জেএইচ