বাংলা সংগীতের মাটি ও মানুষের হৃদয়ছোঁয়া ধারায় যাঁরা সাধনার আলো জ্বালিয়ে গেছেন, তাদের কাতারে আজ এক উজ্জ্বল নাম—মো. রফিক সরকার। সংগীতশিল্পী হিসেবে যেমন তিনি খ্যাতিমান, তেমনি মানবসেবায়ও নিজেকে গড়েছেন সমাজের আলোকবর্তিকা হিসেবে।
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ইটাভরা গ্রামে ১৯৮০ সালের ৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন রফিক সরকার। পিতা মো. আজগর আলী এবং মাতা জামেলা খাতুনের আদর্শ ও স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মায় তার। ঘরোয়া পরিবেশেই সংগীতে হাতেখড়ি হলেও, সংগীত তার জীবনে শুধু পেশা নয়, হয়ে ওঠে সাধনা।
তার সংগীত জীবনে বড় প্রেরণা ছিলেন গুরু পাগল মনির সরকার। তাঁর কাছ থেকেই রফিক সরকার বাউল ও মালয়া সংগীতের সূক্ষ্ম দিকগুলো শিখে আত্মস্থ করেন। এই ধারা ধরে রেখেই তিনি নিজস্ব কণ্ঠ ও দর্শনে বাউল সংগীতকে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশ ও দেশের বাইরে।
১৯৯৪ সাল থেকে রফিক সরকার সংগীতের পাশাপাশি সমাজসেবায়ও আত্মনিয়োগ করেন। দান, সাহায্য, মানবিক সহায়তা—সবই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। সংগীত তার কাছে শুধুই সুর নয়, এটি সমাজবোধ, প্রেম, মানবতা ও আত্মার আর্তনাদের ভাষা।
তার গানে উঠে আসে গ্রামীণ জীবন, মাটি ও মানুষের গল্প, সামাজিক বার্তা এবং হৃদয়গ্রাহী বাউল চিন্তাধারা। তার সুর-সংগীত ছুঁয়ে গেছে ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের মানুষের হৃদয়। ভারতের মহর্ষি মন মোহন আশ্রম বাদু কর্তৃক তিনি সম্মাননা পেয়েছেন “গুনাকর ফকির আফতাবুদ্দিন খাঁ সম্মাননা”। এছাড়াও ২০১০ সালে “এডওয়ার্ড অ্যাওয়ার্ড”, এবং ২০১৮ সালে ভারতের আরও একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন তিনি।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মালয়া ও বাউল সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিত। তিনি সংগীতকে শুধুই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না—বরং এটিকে সমাজ জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তার গানে রয়েছে স্নিগ্ধতা, প্রতিবাদ, প্রেম, দর্শন ও বোধের মিশেল।
বাংলাদেশ বাউল সমিতি ফাউন্ডেশন-এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রফিক সরকার। দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি আজ এক অনন্য নাম। তার সংগীত ও সমাজচিন্তা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
বাণিজ্যিকতার ছাপে যখন সংগীতের প্রাণশক্তি হারাতে বসেছে, তখন রফিক সরকার এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তার গান শ্রোতাদের শুধু মুগ্ধ করে না, বরং ভাবায়, আলোড়িত করে। আত্মার গভীর থেকে উচ্চারিত সেই সুর যেন এক অভ্যন্তরীণ আলোর খোঁজে আমাদের ডেকে যায়।
মো. রফিক সরকার কেবল একজন শিল্পী নন—তিনি এক আত্মিক যাত্রার পথিক। তার সাধনা, সুর ও সমাজসেবার পথচলা বাংলা সংগীতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবেই।
আমার বার্তা/মো. ইয়ামিন/এমই