বিশ্বের প্রায় দেশেই জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করে আসছে। সে হিসেবে এবছর ১৫ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ্বের অনেক দেশেই বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান। পরিবারের প্রধান হিসেবে নানান দায়িত্বের বোঝা থাকে তার কাঁধে। বাবা হওয়ার মতো গুরু দায়িত্বের কারণে তাকেই সইতে হয় বাইরের সব রকম যন্ত্রনা। আবার ঘরের ব্যাপারাগুলোও তাকে ভুলে থাকলে চলে না। ছেলে-মেয়েদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টিও তার নজরে রাখতে হয়। পরিবারের প্রধান হিসেবে সকল ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হয়। বলা যায় মা যদি হয় মধুবৃক্ষ তবে বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান নির্বাহী বা বটবৃক্ষ। মা যদি হয় নদী তবে বাবা হচ্ছেন নৌকার মাঝি।
আসলে বাবার জন্য সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষ কোন দিনের প্রয়োজন নেই। সীমাবদ্ধ বলয়ে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসার অবিরাম ধারা বয়ে চলে বছরের প্রতিটি দিন। অবিরাম ও অনন্তকাল। জীবনের ঘানি টানতে টানতে বাবা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হন, বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তখন তিনি হয়ে পড়েন অনেকটা অসহায়, দুর্বল। রোগ ব্যাধি তাঁকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সময় বাবা চান সন্তান যেন তার পাশে থাকে সব সময়, যেমন তিনি ছিলেন সন্তানের পাশে তার সব প্রয়োজনে পাশে, যখন সন্তান ছিল শিশু অবস্থা। সন্তানের কাছ থেকে অবহেলা কিংবা দুর্ব্যবহার পেলে বাবার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যখন তার প্রিয় সন্তান তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়।
আল কোরআনে বলা হয়েছে- যে সম্পদই তোমরা খরচ কর, তার প্রথম হকদার হলো মা-বাবা। কিন্তু এখন অনেক তথাকথিত সন্তান মা-বাবার জন্যে অর্থ ব্যয়কে অপচয় বলে মনে করে। তারা প্রথম চিন্তা করে তার নিজের সন্তানের ভবিষ্যত রয়েছে। তাকে ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, দামি পোশাক পরাতে হবে। সব সন্তানের মা-বাবাও একইভাবে তাদের জন্যে চিন্তা করেন, কষ্ট করেন। নিজে না খেয়ে সন্তানকে ভালো খাওয়ান। নিজের সব প্রয়োজনকে তুচ্ছ করে সন্তানের প্রয়োজন পূরণ করেন, নিজের সব আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে ছেলে মেয়েদের আরামের চেষ্টা করেন। সন্তানের অসুস্থতায় তারা নির্ঘুম রাত কাটান। তাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়, অনুভব করা সম্ভব। তাই সব সময় বাবা-মাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার সাথে বিশেষ ভাবে স্মরণ করে রাখার জন্যই মা দিবসের মতো বাবা দিনটিকে পালন করছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চলুক প্রতিদিন। "রাব্বীর হাম-হুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা অর্থ্যাৎ হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন; যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।" (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)। ইসলামের দৃষ্টিতে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিন গুণ বেশি। কিন্তু তারপরও জীবন গঠনে মায়ের চেয়ে পিতার ভূমিকা কোন অংশেই কম নয়। মা বহুকষ্টে সন্তানকে পেটে ধারণ করেন কিন্তু বাবা সমগ্র পরিবারকে ছায়ার মতো আগলে রাখেন।
পরিবার হল অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম শিক্ষক হচ্ছেন মা-বাবা। এজন্য বলা হয়ে থাকে- একজন সন্তানের জন্য পারিবারিক সুশিক্ষাটি খুব বেশি জরুরি এবং সেটি অবশ্যই আদর্শ শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হয়। আর এর সঙ্গে যোগ হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ডিগ্রি। গুণীজনরা বলেন, পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ। মা-বাবার কাছেই শিশুর শিক্ষা-দীক্ষা শুরু। মূলত শিশুরা বাবা-মা’র কাছেই লেখাপড়া, নৈতিকতা, আদর্শ বা দেশপ্রেম সম্পর্কে জানতে শুরু করে। তাই মা-বাবাই হচ্ছেন শিশুর প্রথম আদর্শ শিক্ষক। কিংবা মা-বাবাকেই শিশুরা তাদের প্রথম আদর্শ গুরু হিসেবে মানতে শুরু করে। আর সে কারণে শিশুর বেড়ে ওঠায় মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজন।
একটা শিশুর বেড়ে উঠতে সাধারণত বাবা-মা দুজনের অবদানই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বাবারা বেশীরভাগই ক্ষেত্রেই পরিবারের অর্থনৈতিক চাপটা সামাল দিয়ে থাকেন, ঘর সামলানোর কঠিন কাজে থাকেন মায়েরা। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, যে সকল বাবারা তার সন্তানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন তাদের সন্তানরা বেশী সুখী এবং আত্মবিশ্বাসী বোধ করেন। সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে চাইলে বাবাকে নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও আশার কথা এই যে, বর্তমানে অনেক বাবারা পরিবারে সন্তান লালন পালনে সরাসরি অবদান রাখছেন। অনেক বাবাই শিশুর খাদ্য থেকে শুরু করে সার্বিক যত্ন করে থাকেন। মা-বাবা কর্মজীবি হলে শেয়ার করেই শিশুর যত্ন নিতে হয়।
সন্তান যখন ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়, তখন বাবা মাকে এ জন্য শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হয়। সন্তানের প্রতি বাবা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হয়। যার ঔরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া। যার কাজ দুঃখ কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখে সন্তানকে ভালবাসার আর্দ্রতা উপহার দেয়া। রক্তের বাঁধনে বাধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। সন্তানের ভালবাসায় পিতা ভক্ত আর সন্তানের সুশিক্ষা ও শ্রদ্ধায় পিতা সিক্ত।
আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের জীবনটাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি তাহলে বাবা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে চোখের সামনে, মনের পর্দায় ছায়া ফেলেন। বাবা যে বাবাই। তার সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। যার কারণে এই পৃথিবীর রঙ, রূপ, সৌন্দর্য দেখার সুযোগ লাভ করেছি সবাই সেই বাবা নামটির সঙ্গে যে অপার স্নেহ আর মমতার অদ্ভুত এক মিশেলে আর দৃঢ় বন্ধনে আমরা জড়িয়ে থাকি। একজন ছেলে কিংবা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিকবার উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে ‘বাবা’ই অন্যতম। একজন শিশু পৃথিবীতে আসার পর আধো আধো বোলে যখন কথা বলতে শুরু করে তখন তার মুখ থেকে ‘বাবা’ এবং ‘মা’ শব্দ দুটি প্রথম উচ্চারিত হয়। বাবা যেন সন্তানের কাছে এক মহীরুহ। সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনে যে কোন বাবাই পুলকিত হন। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মধুর ভালবাসা তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু ঘর আলোকিত করে শিশু সন্তান এবং তাদের মা বা বাবা ডাক তাদের মুখ উজ্জ্বল করে, হৃদয়ে অন্য রকম শিহরণ তৈরি করে দাম্পত্য জীবনকে স্বার্থক প্রমাণ করে।
বাবাকে সন্তানের রোল মডেল হতে হয়। যেমন আপনি যদি রাতের বেলা ব্রাশ করে, ফ্রেস হয়ে শুতে যান, আপনার সন্তানও তাই করবে। শিশু বাবাকে অনুসরণ করে থাকে। তাই তার বই পড়ার মতো ভালো অভ্যাস গড়তে হলে আপনাকেও বই পড়তে হবে, তার রোল মডেল হতে হবে। তবে, বাবা এক কঠিন যোদ্ধার নাম। যে যোদ্ধা শত কষ্টের পরও একাই তাঁর পরিবারকে ঠেলে নিয়ে চলেন। কিন্তু পরিবারের বাকিদের কখনোই বুঝতে দিতে চান না যে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। বাবারা একেকটি পরিবারের বটবৃক্ষ, যাঁরা কিনা বছরের পর বছর পরিবারের সদস্যদের আগলে রাখেন সব বিপদ-আপদ থেকে। এই বটবৃক্ষের ছায়াতেই তো আমরা বাঁচি।
বাবা, পরিবারের বটবৃক্ষ। তপ্ত দায়িত্বগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে পরিবারকে সারাজীবন ছায়া দিয়ে যায়। বাবারা রাগ করে না, তাদের কষ্টগুলো শুধু হাওয়ায় মিশে যায়, অনেকটা আড়ালে আবডালে। কেউ তার খবর রাখে না, খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। কখনো কোনো সন্তান বাবাকে বলতে শুনেছে কি "আমি ভালো নেই"? এ প্রশ্নের নেই। এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে একজন মানুষ কিভাবে এত সহ্য করে! বুকে ব্যথা বা শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তার পক্ষে বাজার করতে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। মা হয়তো শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু লুকাতে পারে। কিন্তু বাবা? কোথায় লুকায়? কেউ কি জানে? প্রকাশ্যে তার চোখে জল আসাও নিষেধ, সে যে বাবা। শার্ট বা পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছতে মুছতেই চলে যায় বাবাদের বেলা। নিজে ছেঁড়া কাপড় পড়েও সন্তানের জন্য ভাল কাপড়টি কিনতে কার্পণ্য করেন না। বড়জোর ক্ষণিকের তরে কিছুটা গম্ভীরমুখে বসে থাকতে পারে। তার তো ভেঙে পড়লে চলবে না। যার কাছে ছায়া নেই, শুধু সেই বোঝে কি নিদারুণ তপ্ত দিবস এই পৃথিবীর, কত রুদ্ধশ্বাস দায়িত্বে ভরা এই বন্ধুর পথ। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কত ভয়ংকর সেসব সন্তানেরাই জানে।
বাবারা সবসময় তাদের সন্তানের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিতে পছন্দ করেন। যুগে যুগে বিভিন্ন বাবা তাদের সন্তানের জীবনকে সুন্দর করার জন্য তাদের নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। তাদের দৈহিক পরিশ্রম এবং মানসিক পরিশ্রম দিয়ে যে অর্থ উপার্জন করেছেন তা সম্পূর্ণই ব্যয় করেছেন তাদের সন্তানের মঙ্গল এর জন্য। বাবাদের কোনো দিবস নেই, বাবাদের জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। বাবাদের জন্য নিরন্তর ভালবাসা। ভালো থাকুক সব বাবারা, আড়ালে আবডালে, এপারে এবং ওপারে, ইহকাল ও পরকালে, সবসময়।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/জেএইচ