দেশে বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হচ্ছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। গত মঙ্গলবার খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও ডেঙ্গু নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৫ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৮৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৭ জন। অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ আমার বার্তাকে বলেন, ‘আমরা শুনছি যে ঢাকায় আক্রান্তদের মধ্যে অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের মৃত্যু বেশি হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি অন্য। সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বল্পতা আছে। ফলে ঢাকার চাইতে ঢাকার বাইরে এই মুহূর্তে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।
ডা. আলী আজম নামে একজন চিকিৎসক আমার বার্তাকে বলেন, আমাদের মন্ত্রী তার মাকে হারিয়েছেন এই রোগে। তিনি সব সময়ই প্রতিবাদী এবং প্রকৃত অর্থেই স্বাস্থ্য সেবায় তার বলিষ্ঠ অবদান রেখেছেন এবং রাখতে চান। কিন্তু তার কথাই কি শেষ কথা ? মন্ত্রী সোচ্চার কণ্ঠে যতোই বলুক না কেন, বাস্তবে তার প্রতিফলন চোখে পড়বার মতো নয়। অভিযোগ উঠেছে, সমস্যা মোকাবিলায় কোথাও কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই।
ডা. আজম আরো বলেন, গত বছরের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মৃত্যু পর্যালোচনার জন্য একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পর্যালোচনা এখন পর্যন্ত শেষ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ পর্যন্ত কোনো বিশ্লেষণও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( রোগনিয়ন্ত্রণ) শেখ দাউদ আদনান আমার বার্তাকে বলেন, ‘আমরা খুব শিগগির মৃত্যু পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশ করব।’
২০০০ সালে দেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল। ব্যতিক্রম ছিল ২০২০ সাল। এ বছর করোনা মহামারি দেখা দেয়। দেশে ডেঙ্গু রোগী ছিল কম, সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু ছিল না। তখন জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, একই সময়ে দুটি ভাইরাস সমান সক্রিয় থাকতে পারে না। করোনার জীবাণুর তীব্রতায় ডেঙ্গু ভাইরাস অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। করোনা মহামারি শেষ না হতেই ২০২১ সাল থেকে আবার ডেঙ্গু বাড়তে থাকে।
ডেঙ্গুবিশেষজ্ঞ ও ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার দশমিক ৫। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ব্রাজিলে। কিন্তু সেই ব্রাজিলেও মৃত্যুহার এত না।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, করোনা মহামারি শুরুর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৮। এর মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। মৃতের হার ছিল শূন্য দশমিক ৩৭। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা যান ২৮১ জন। গত বছরও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। মৃত্যুহার বেড়ে হয় শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গুতে যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন, মৃত্যুও তত বাড়বে। তবে মৃত্যু বেশি হওয়ার আরও কিছু কারণ আছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সব সরকারি হিসাবে আসেনি। একবার আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা বেশি হয়। ঢাকা শহরে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া রোগী অনেক বেড়ে গেছে।
ডেঙ্গুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘দ্বিতীয়বার আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউনিটি কমপ্লেক্স রিঅ্যাকশন দেখা দেয়। এসব রোগীর প্লাজমা লিকেজ বেশি হয়। রোগী শকে চলে যান। মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ।’
কারণ আরও আছে। জ্বর হওয়ার পরও অনেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। হাসপাতালে রোগী আসছে অনেক দেরিতে, অথবা পরিস্থিতি অনেক জটিল হওয়ার পর।
গত বছর ডেঙ্গুতে ঢাকা শহরে মারা গিয়েছিলেন ৯৮০ জন। ঢাকা শহরের বাইরে মারা গিয়েছিলেন ৭২৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মৃত্যু পর্যালোচনার জন্য শুধু ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে ৯৪ জন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ঢাকার বাইরের রোগীর কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। পর্যালোচনায় ঢাকা শহরের বাইরের রোগীর তথ্যও থাকা দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।