ছেলের জন্য জঙ্গিবাদ থেকে ফেরা মায়ের ব্যাকুলতা

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২২, ১১:০০ | অনলাইন সংস্করণ

  কাজী সামাদ

  প্রিন্ট ভার্সন

চাইলেন প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা

অনুশোচনায় কাঁদলেন কেবিন ক্র কাঁদালেন সবাইকে

দেশের বেসরকারী বিমান পরিবহন প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি করতেন আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। এছাড়া জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশেও খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন তিনি।

পরিবারসহ থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। এমিলির ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানের (১৫) গৃহশিক্ষক ছিলেন আল আমিন। সেই শিক্ষকের মাধ্যমেই এমিলি ও রাইয়ান নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’তে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

এরই মধ্যে এমিলিকে উদ্ধার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। তবে ছেলে রাইয়ান এখনো নিরুদ্দেশ।

সুন্দর ও নিরাপদ জীবন ফেলে বিপথে চলে যাওয়ায় অনুতপ্ত এমিলি। তিনি বলেন, ‘আমি একসময় এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রু ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলেকে উদ্ধারের জন্য সহায়তা চাই। আমার ছেলের মতো যেন আর কোনো সন্তান এভাবে জঙ্গিবাদে না জড়ায়।’
 

এরই মধ্যে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে নিরুদ্দেশ আছেন রাইয়ান। অথচ এমিলি নিজেই ছেলেকে জঙ্গিবাদের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। পাহাড়ে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। নিরুদ্দেশ হয়ে বর্তমানে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত ৫৫ জনের একজন এই রাইয়ান। তাকে ধরতে র‌্যাবের অভিযান চলছে।

গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে এমিলিকে পরিবারের হাতে হস্তান্তর করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এসময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
 

র‌্যাব জানায়, গত মার্চে নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান নামের এক তরুণ নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় তার বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু তখনো তিনি স্ত্রী-সন্তানের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানতেন না।

পরে র‌্যাব নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করলে রাইয়ানের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।গত ৩ নভেম্বর র‌্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠনটির মহিলা শাখা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়।

এসময় পুলিশের এই এলিট ফোর্স জানতে পারে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশে হিজরতে (পাহাড়ে) পাঠিয়েছেন।

গত ৫ নভেম্বর এমিলিকে উদ্ধার করার পর চারদিন ডি-রেডিকালাইজেশনের (উগ্রবাদ থেকে ফেরানো) মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় রাখা হয়।

উদ্ধারের পর এমিলি র‌্যাবকে জানান, তিনি ও তার ছেলে গৃহশিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে ২০২১ সালের শুরুর দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং নতুন জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন।

পরবর্তী সময়ে রাইয়ান ২০২২ সালের মার্চে শিক্ষক আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হন।

এরপর আর বাড়িতে ফিরেননি। গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আল আমিনের নির্দেশনায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার রনি মিয়া পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য রাইয়ানকে বান্দরবানে দিয়ে আসেন।
 

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে র‌্যাব সদরদপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী আব্দুল হাদি সুমন ওরফে জন, আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ এবং রনি মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে তিনটি উগ্রবাদী বই, নয়টি লিফলেট এবং দুটি ব্যাগ।

অনুশোচনায় কাঁদলেন কেবিন ক্রু, কাঁদালেন সবাইকে : ‘চরম একটা ভুল পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম। আজকে আমার আদরের সন্তান বান্দরবানে পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায়। আমি জানি না আমার সন্তান বেঁচে আছে কি না। জানি না কখনো তাকে আর দেখতে পারবো কি না।

এটা আমার মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি কোনটা সঠিক কোনটা ভুল। আমার কুরআন-হাদিসের দক্ষতা কম ছিল। আমাকে ও আমার রাইয়ানকে ডিমোটিভেটেড করা হয়েছে। ভুল পথে নেয়া হয়েছে।’
 

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে এভাবেই র‌্যাবের প্রেস ব্রিফিংয়ে অনুশোচনায় কাঁদছিলেন আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। শুধু তিনিই যে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন তা নয়, নিজের ১৫ বছর বয়সী ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকে নিয়েছেন সেই পথে।

এমিলি ঘরে ফিরে এলেও তার সন্তান এখনো নিখোঁজ। ছেলেকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাংবাদিকদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন এই মা।
 

কান্না করতে করতে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে এমিলি বলেন, ‘আব্বুৃ তুমি যদি আমার মেসেজ পেয়ে থাকো, তাহলে বলছি তুমি চরম ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো।

তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, বিশৃঙ্খলা করবে না। আমি অনুরোধ করছি তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবে।’
এমিলি জানান, তার স্বামী ছেলের শোকে অসুস্থ। আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগল প্রায়।

‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার’ আরও ৩ সদস্য গ্রেপ্তার:
এদিকে, নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র যোগানদাতাসহ আরও তিন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। 
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী আব্দুল হাদি সুমন ওরফে জন (৪০), আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ (৩২) ও রনি মিয়া (২৯)। 

 

মঙ্গলবার দিবাগত রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ সদস্যরা রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
 

এসময় তাদের কাছ থেকে তিনটি উগ্রবাদী বই, নয়টি লিফলেট এবং দু’টি ব্যাগ জব্দ করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারস্থ র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।

 

গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন জানান, আবদুল হাদি সুমন ওরফে জন সুনামগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি দেড় বছর আগে শুরা সদস্য সৈয়দ মারুফ ওরফে মানিকের মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ছিলেন সংগঠনের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত অর্থদাতা।
র‌্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, ৩ মাস আগে সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবকে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য ৯ লাখ টাকা দেন জন। ইংল্যান্ডে অবস্থানরত তার দুই ভাইয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় দান করার কথা বলে এই টাকা সংগ্রহ করেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা সংগঠনে চাঁদা দিতেন।

এবি/ওজি