এরিককে নিয়ে টানাটানি!

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২২, ১২:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

  মুনিরুল তারেক

  প্রিন্ট ভার্সন

# এরশাদ ট্রাস্ট পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় জিডি
# এরিককে নির্যাতন ও ট্রাস্টের নথি গায়েবের অভিযোগ বিদিশার বিরুদ্ধে

নানা কাণ্ডে সম্প্রতি আলোচনায় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই এবার সামনে এলো এরশাদ-সংশ্লিষ্ট নতুন ঘটনা।

তার পুত্র এরিক এরশাদকে নিয়ে শুরু হয়েছে টানাটানি। পুত্র এরিকের প্রতি ভালবাসার অনেক নিদর্শন রেখে গেছেন এরশাদ।

এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিজ নামে গড়া এরশাদ ট্রাস্টের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির একমাত্র সুবিধাভোগী করে গেছেন এরিক এরশাদকে।

সেই সম্পত্তি নিয়েই যত কাড়াকাড়ি। এরিক বাড়িধারায় প্রেসিডেন্ট পার্কের বাড়িতে থাকছেন তার মা বিদিশা সিদ্দিকের সঙ্গে।

তবে এরশাদ ট্রাস্টের কেউ নন তিনি। মূল্যবান সম্পত্তির মাঝে ছেলের সঙ্গে বাস করলেও কোন কিছুতেই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই বিদিশার। যে কারণে নানা কায়দায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

পাশাপাশি ট্রাস্ট পরিচালনায় যারা আছে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করান এরিককে দিয়ে।
অপরদিকে, এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন মরহুম এইচএম এরশাদের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত কাজী মামুনুর রশিদ।

অভিযোগ আছে, ট্রাস্টের সম্পত্তির দিকেই তাকিয়ে এর পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিরা। তারাও বিদিশা এবং এইচএম এরশাদের ছোট ভাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ট্রাস্ট থেকে দূরে রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোপূর্বে।

যার নামে ট্রাস্ট, তার পরিবারের লোক হয়েও অনেকে যুক্ত হতে পারছেন না পরিচালনা পর্ষদের কূটকৌশলে।

মা বিদিশা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ তুলে নিজেকে অবরুদ্ধ দশা থেকে উদ্ধার করতে সহায়তা চেয়েছেন এরশাদপুত্র এরিক এরশাদ।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে পুলিশের সহযোগিতায় প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা থেকে বিদিশাকে বের করে দেওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন এরশাদপুত্র।

এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদকে ফোন করে বিদিশার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন এরিক এরশাদ।
এদিকে, কাজী মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে গুলশান থানায় একটি জিডি দায়ের হয়েছে। ওই জিডির বাদী হিসেবে এরিক এরশাদের নাম রয়েছে। তবে জিডির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কাজী মামুনুর রশিদ।

এরিক-কাজী মামুনের কথোপকথনঃ
কাজী মামুনুর রশিদের সঙ্গে কথোপকথনে এরিক এরশাদের মুখে শোনা গেছে, তার মা বিদিশা ওই বাসায় থাকলে সে আত্মহত্যা করবে।

এরিক অডিও বার্তায় আরও বলেছে, আয়শা নামে একটি মেয়ে আছে। তার সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক আছে এই অভিযোগ তুলে আয়েশাকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে তো আমার শারীরিক সম্পর্ক নেই।

মা বিদিশাকে ‘মীরজাফর’, খুনি এরশাদ শিকদারের সঙ্গে তুলনা করে এরিক এরশাদ বলেন, ‘আমার বাঁচাটা জরুরি। আজকে তিনি (বিদিশা) যদি এই বাসায় থাকেন তাহলে আমি এই বাসায় থাকব না।’

যা আছে এরিকের জিডিতেঃ
গত সোমবার এরিক এরশাদ বাদী হয়ে গুলশান থানায় করা জিডিতে (নম্বর ৫৪০) উল্লেখ আছে, এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ গংরা যে কোনো সময় প্রেসিডেন্ট পার্কে গিয়ে হামলা চালাতে পারে।

জিডির অভিযোগে এরিক উল্লেখ করেছে, ৬ নভেম্বর কাজী মামুনুর রশিদ ও কাজী রুবায়েত গংরা আমার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় অতির্কিতভাবে চলে আসে। তারা আমার বাসায় এক ঘণ্টা অবস্থান করে।

তারা আমাদের বাসা দখল নিতে চায়। দখল নেওয়ার জন্য আমাদের হুমকিও দিয়েছে। তারা আমাদের বাসায় কোনো নাশকতামূলক দ্রব্য রেখে যেতে পারে বলে সন্দেহ হচ্ছে।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়, এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ নন। বর্তমানে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার (অব.) তানভীর ইকবাল।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এরিক এরশাদ এখন তার মায়ের কাছে বন্দি।

আমাদের (ট্রাস্টের) সব সদস্যসহ গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে এরিককে খোলামেলা কথা বলতে দিলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

কাজী মামুন বলেন, ‘এরিক আমার কাছে সহায়তা চেয়েছেন। তার মা তাকে মানসিক অত্যাচার করছেন। তার অডিও বার্তা তো আমার কাছে রয়েছে। এই জিডিতে স্বাক্ষর কার তা খতিয়ে দেখা উচিত।’

এরশাদ ট্রাস্টের সদস্য আ্যাডভোকেট রুবায়েত বলেন, ‘এরিকের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে ট্রাস্টের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘এরিক অবরুদ্ধ। এরিকের মা বিদিশা এক মাস আগে এরিকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে।’
তবে এসব বিষয়ে জানতে বিদিশা সিদ্দিকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ না করায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জিডির বিষয়ে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ ফরমান আলী বলেন, ‘ওনারা মাঝে মধ্যে এভাবে জিডি করে থাকেন। আমরা সবগুলো তদন্ত করে দেখি।’
পুলিশের গুলশান জোনের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, এরশাদ ট্রাস্টের একাধিক জিডি গুলশান থানায় রয়েছে। এটি তাদের রুটিন ওয়ার্ক। জিডি হচ্ছে, কেউ সরাসরি মামলা দায়ের করছেন না।

সূত্রে জানা গেছে, এরশাদ ট্রাস্টে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা এফডিআর করা আছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা আয় হয়। এছাড়া ট্রাস্টের অধীনে গুলশানে ২ হাজার 
স্কয়ার বর্গফুটের ফ্ল্যাট থেকে মাসে ৪৫ হাজার টাকা আয় হয়। বনানীর একটি ফ্ল্যাট থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় হয়। গুলশানের একটি দোকান থেকে মাসে ২ লাখ টাকা আয় হয়।

এছাড়া রংপুরে একটি কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে। কোল্ডস্টোরেজ থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে ৩০ লাখ টাকা আয় হয়। সব টাকা ট্রাস্টের মাধ্যমে এরিক এরশাদ সুবিধাভোগী।

ট্রাস্টের নথি গায়েবে অভিযুক্ত বিদিশাঃ
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের লাইব্রেরিটি বর্তমানে এরশাদ ট্রাস্টের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরশাদ বেঁচে থাকতে লাইব্রেরিটি ট্রাস্টের কাজে ব্যবহারের জন্য লিখে দেন।

ওই অফিসেই এরশাদ ট্রাস্টের দলিল দস্তাবেজ, রেজুলেশনসহ অন্যান্য নথিপত্র রাখা ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করেই সেইসব নথিপত্র গায়েব হয়ে গেছে। সে কারণে এবার এরশাদপুত্র এরিকের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন এরশাদ ট্রাস্টের বোর্ড পরিচালকরা।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাস্টের সুবিধাভোগী এরিকের নিরাপত্তায় এবার আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।

যদিও এর আগে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। সোমবার এরশাদ ট্রাস্টের নথিপত্র গায়েবের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানায় জানানোর পাশাপাশি এরিকের নিরাপত্তার বিষয়টিও ফের অবহিত করা হয়।

জানা গেছে, সোমবার এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ, অ্যাডভোকেট রুবায়েতসহ অন্যান্য সদস্যরা অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা দলিল-দস্তাবেজ ও রেজুলেশনসহ অন্যান্য নথিপত্র খুঁজে পাননি। অফিস থেকে সবকিছু গায়েব হয়ে গেছে।

পরে ট্রাস্ট অফিসের কর্মকর্তা জেমস্ অরবিন্দু হালদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নথিপত্র কোথায়?- তিনি এর সঠিক কোনো জবাব দিতে পারেননি।

বিষয়টি তৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট থানায় অবহিত করা হয়েছে। জেমস্ অরবিন্দু হালদার বিদিশার নিয়োগপ্রাপ্ত। সেই হিসেবে ট্রাস্টের যাবতীয় কাগজপত্র গায়েব হওয়ায় সন্দেহের তীর এখন বিদিশার দিকে।

কাজী মামুনকে ফাঁসানোর জন্য এরশাদ পরিবারের কারও ইঙ্গিতে এই নথিপত্র গায়েব করা হয়েছে বলে একটি সূত্রের দাবি।
ট্রাস্টের সদস্য অ্যাডভোকেট রুবায়েত বলেন, ‘ট্রাস্টের নথিপত্রগুলো পাওয়া না গেলে খুব ক্ষতি হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা বিষটি থানায় অবহিত করেছি। গায়েব হওয়া কাগজপত্র না পেলে আমরা আইনের আশ্রয় নেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাস্টের সুবিধাভোগী একমাত্র এরিক এরশাদ। এরিকের চাহিদা অনুযায়ী ট্রাস্টের বোর্ড বৈঠক করে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দেয়।’
 

রুবায়েত বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদসহ আমরা কয়েকজন এরিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

কিন্তু বিদিশা এরিকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। বরং তিনি আমাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এতে আমাদের সন্দেহ বেড়েছে।’

অ্যাডভোকেট রুবায়েত জানান, ‘বিদিশা এরশাদ ট্রাস্টের সদস্য নন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ট্রাস্টের মেমোরেন্ডামে স্পষ্ট লিখে গেছেন, এই ট্রাস্টের ওপর এরিকের মা বিদিশার কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এমনকি তিনি প্রেসিডেন্টপার্কের এই বাসায় প্রবেশ করতে পারবেন না।

যদিও পরবর্তী সময়ে বোর্ড সভায় এরিকের সবদিক ভেবে-চিন্তে মানবিক কারণে বিদিশাকে এরিকের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি এমন যে, বিদিশাকে প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে বের করে দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া লাগতে পারে। কারণ এরিকের বয়স এখন ২২ বছর।তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। প্রয়োজনে এরিকের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।’

এবি/ওজি