মানুষ আসলেই কষ্টে আছে
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ
মানিক মুনতাসির :
এর মধ্যেও আমরা চরম এক বিতর্কে অবতীর্ণ-ভোট হবে কিসে? সাধারণ ব্যালটে নাকি ইভিএমে। এরইমধ্যে ইভিএম কিনতে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ সবদিকে মাইক বাজিয়ে কৃচ্ছতাসাধনের কথাও বলা হচ্ছে।
মাস ছয়েক আগে আমি ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলাম। তখন সম্ভবত জুনের মাঝামাঝি কোন এক দিন। রোজার মাস। ব্কিালে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসবভনের সামনে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে চরম এক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছিল। তবে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। পুলিশ সুশৃঙ্খলভাবে এই মাইনরিটি গ্রুপটাকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল পুরো সময়। সমাবেশের শ্লোগানে তারা সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে গালি গালাজও করছিল। কেউ কেউ কুশপুত্তলিকাতেও লাথি মারছিল। কিন্তু পুলিশকে দেখলাম অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আন্দোলনকারীদের সহায়তা করতে।
ইতিহাস অনুযায়ী গণতন্ত্রের সুতিকাগার বলা হয় গ্রীসকে। আর আধুনিক গণতন্ত্রের জনক রাষ্ট্র বলা হয় বৃটেনকে (ইংল্যান্ড)। লীজ ট্রাস নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৪৯ বা ৫০ দিনের মাথায় তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ২৫ অক্টোবর ২০২২। লীজ ট্রাস ব্যর্থতার গ্লানী নিয়ে চলে গেলেও তাঁর উত্তরসূরী ঋসি সুনাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার দেওয়া বক্তব্যে লীজের ব্যর্থতার ব্যাপারে কোন কথা বলেননি। বরং বলেছেন তিনি সঠিক পথেই ছিলেন। আমাদের সবার হয়তো ভুল ছিল। ইংল্যান্ড বর্তমানে ইতিহাসের ভয়াবহ আর্থিক সংকটকাল পার করছে বলেও প্রথম ভাষণে বলেছেন ঋসি। ক্ষমতার এই পালাবদলে কোন সংঘাত, মারামারি, মিছিল, বিক্ষোভ কিংবা হাতাহাতি বা চুলোচুলির দরকার হয়নি। মাত্র কয়েকদিন আগে দেশটি তাদের রানীকেও হারিয়েছে। এরপরও দেশের কোথাও কোন সংঘাত হয়নি। এটাই আসলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এটাই জনগনের আস্থা-অনাস্থার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। নিজের ব্যর্থতা বুঝতে পেরে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াও এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা। যা সবাই পারে না। শুধু এই লীজ ট্রাসরাই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সারাবিশ্বে যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে পরিচিত আমেরিকাতেও নির্বাচন কিংবা ক্ষমতার পালাবদল হয়ে থাকে অনুকরণীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ঋসি সুনাক ১২ মে ১৯৮০ সালে সাউদাম্পটন, হ্যাম্পশায়ারের সাউদাম্পটন জেনারেল হাসপাতালে। ভারতীয় পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকান-জন্মকৃত হিন্দু পিতা-মাতা যশবীর এবং উষা সুনাকের সন্তান। সে হিসেবে তিনি একজন ভারতীয় বংশোউদ্ভুত। অথচ এই বৃটেন ভারতীয় উপমাহদেশকে শাসন এবং শোষন করেছে প্রায় দুইশত বছর। এটা অবশ্য বৃটিশদের দাবি। প্রকৃতপক্ষে এটা ৯০ বছরের মত।
আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর মাত্র বছর খানেক পরই। এ দেশে নির্বাচন মানেই বিরাট এক যজ্ঞ। জ্বালাও, পোড়াও। হানাহানি। কাটাকাটি। মারামারি। হাঙ্গামা। ইত্যাদি। আর ক্ষমতার হস্তান্তর তো আরো যন্ত্রণার। কোন দলই চেয়ার থেকে নামতে চায় না। ব্যর্থতার সাগরে হাবুডুবু খেলেও নাক উঁচিয়ে নি:শ্বাস বন্ধ রেখে জনগনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে গলা ফাটিয়ে বলে আমরাই কেবল সর্বেসর্বা। আমরাই সফল। আমরাই শ্রেষ্ঠ শাসক। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এদিকে বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে কঠিন এক মন্দা। যাকে শতাব্দীর ভয়াবহ মন্দা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ। একই সঙ্গে ঘনিয়ে আসছে দূর্ভিক্ষ। এর মধ্যেও আমরা চরম এক বিতর্কে অবতীর্ণ-ভোট হবে কিসে? সাধারণ ব্যালটে নাকি ইভিএমে। এরইমধ্যে ইভিএম কিনতে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ সবদিকে মাইক বাজিয়ে কৃচ্ছতাসাধনের কথাও বলা হচ্ছে।
যাই হউক শেষ কথা: মানুষ আসলেই কষ্টে আছে। বেশিরভাগই মানুষই আর্থিক কষ্টে আছে। তবুও মানুষ ভাল থাকার ভান করছে। নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার না করে নিজের জীবন বাজি রেখে নিজেকে সফল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কেননা সফল মানুষকেই সবাই অনুসরণ করতে চায়। আর ব্যর্থ মানুষকে ডাস্টবিনে কিংবা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করাই যেন ইতিহাসের দায়িত্ব। অথচ এই ব্যর্থতার গল্পগুলোর মধ্যেও যে কত রকমের সত্য আর স্বরনীয় ঘটনা থাকে তা আমলে নিতে চায় না কেউই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক