ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের ক্ষতি ১২১৮ কোটি টাকার বেশি
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ১৩:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

ঈদুল আজহায় ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতের ১২ দিনে সারাদেশে ৩৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১২ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন এক হাজার ৫৭ জন। এছাড়া এসব দুর্ঘটনায় ৫৮৯টি যানবাহন সম্পৃক্ত হয়েছে। দুর্ঘটনায় ১২১৮ কোটি টাকার বেশি মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
বুধবার (১৮ জুন) সংবাদ মাধ্যমে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের পাঠানো দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। গত ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত হিসাব করে এই ১২ দিন ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ১২শ ১৮ কোটি ৭২ লাখ ৮৬ হাজার টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসাবের সঙ্গে আরও ৩০ শতাংশ যোগ করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল রোড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের মেথড অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ঈদুল আজহার আগে-পরে ১৩ দিনে ২৬২ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২০.১৫ জন। এবছর প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এই হিসেবে গত বছরের তুলনায় প্রাণহানি বেড়েছে ২৯.০৩ শতাংশ।
এবারের ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ঈদের আগে ঘরমুখী যাত্রায় ছুটি কম থাকায় একসঙ্গে বহু মানুষের যাত্রার কারণে যানবাহনের ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পিকআপে, ছোট ও স্বল্পগতির নানা প্রকার অনিরাপদ যানবাহনে যাত্রা করেছে। এই অবস্থা ঈদের ফিরতি যাত্রাতেও অব্যাহত ছিল। সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন বিকল হওয়া, দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া এবং বৃষ্টিতে সড়ক নষ্ট হওয়ার কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি হয়েছে। চালকরা বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানোর কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং সড়কে দাঁড়ানো ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহত বেশি হয়েছে। যানবাহনের চাকা ফেটে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং পথে পথে যাত্রী হয়রানি চরম পর্যায়ে ছিল বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
আরও বলা হয়, ঈদ উদযাপনকালে মাত্র ৪/৫ দিনে বিপুল সংখ্যক মানুষকে পরিবহন করার মতো মানসম্পন্ন নিরাপদ গণপরিবহন আমাদের নেই। ফলে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে গন্তব্যে যাত্রা করেন এবং দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। অবশ্য দায়িত্বহীনতা ও অসচেতনতার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আসলে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে কমপক্ষে ৩ বছরের একটি মধ্যমেয়াদি টেকসই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনার অধীনে রেললাইন সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে সড়ক পথের মানুষকে ট্রেনমুখী করতে হবে। নদীপথ সংস্কার ও জনবান্ধব করতে হবে। সড়কে বিআরটিসির রুট বিস্তৃত করে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সড়কের সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। ঈদযাত্রায় পোশাক শ্রমিকরা যাতে পর্যায়ক্রমে ছুটি উপভোগ করতে পারেন সেজন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পোশাক শ্রমিকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব উদ্যোগ ঠিকমতো বাস্তবায়ন করলে পরবর্তী সকল ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে।
যানবাহনের চালকরা তাদের নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে মানসিকভাবে অস্থির থাকেন। তাদের মধ্যে জীবনবোধ ঠিকমতো কাজ করে না। সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। এই প্রেক্ষাপটে পরিবহন চালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগের সমন্বয় এবং ধারাবাহিকতা নেই। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করে ফাউন্ডেশনটি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশগুলো হচ্ছে— দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সবমহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেল ব্যবহার নিরৎসাহিত করতে হবে; ঈদের আগে-পরে সরকারি ছুটির সঠিকভাবে বিন্যাস করতে হবে; সড়ক, নৌ ও রেলপথে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে এবং সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমার বার্তা/জেএইচ