যুদ্ধ করতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ১২:০৮ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। রোহিঙ্গাদের এ বিদ্রোহ মিয়ানমারে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ককে ভয়াবহ ক্ষতি এবং প্রত্যাবাসন সম্ভাবনাও ক্ষীণ করবে। বাংলাদেশের উচিত রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ত্রাণ সহায়তা ও সীমান্ত বাণিজ্য জোরদার করা। একই সঙ্গে আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানো।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের তৈরি করা ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি’ শীর্ষক এশিয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সময় আজ বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিক প্রকাশের কথা রয়েছে।
প্রতিবেদনে ক্রাইসিস গ্রুপ জানায়, রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির বিজয়ের পর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়। বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরগুলোতে বছরের পর বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী অন্তর্দ্বন্দ্বের পর এই গোষ্ঠীগুলো গত নভেম্বরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। সমঝোতার পর রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতার মাত্রা অনেকাংশে কমে গেছে। গোষ্ঠীগুলো সদস্য সংগ্রহও বাড়িয়েছে। কারণ, আরাকান আর্মি মূলত রাজ্যের বৌদ্ধদের সমর্থন পেয়ে আসছিল। ফলে রাখাইনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ে নামানোর জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। ফলে বাংলাদেশ সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে পরীক্ষামূলক আলোচনা শুরু করেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান হামলা শুধু এই আলোচনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না; বরং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাবও উস্কে দিতে পারে, যা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করবে। বাংলাদেশের উচিত ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানো এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। আরাকান আর্মিরও উচিত সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে তারা শাসন করতে পারবে, তা দেখানোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে যখন আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে এগোতে শুরু করে, তখন সংখ্যায় কম থাকা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের সঙ্গে মিলে লড়াইয়ের জন্য রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মোতায়েনের চেষ্টা করে। সামরিক বাহিনী জোর করে রোহিঙ্গা পুরুষদের মিলিশিয়া ইউনিটে নিয়োগ করে, স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের জন্য সম্প্রদায়টির নেতাদের সঙ্গে কাজ করে এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে।
এই গোষ্ঠী আগে দৃশ্যত রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রোহিঙ্গা মোতায়েন আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রাকে ধীর করে দেয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী এটিকে পুরোপুরি প্রতিহত করতে পারেনি। অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু আরাকান আর্মির প্ররোচনামূলক বক্তব্য ও উত্তর রাখাইনে তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের অভিযোগ এই জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সামরিক বাহিনীর চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে দেখতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গাকে প্রভাবিত করেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মংডু টাউনশিপের পতনের আগেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে শুরু করে। নভেম্বরে তারা একটি ‘সহাবস্থান’ সমঝোতায় পৌঁছায় এবং পরের মাসেই আশ্রয়শিবিরে একটি বিশাল ‘ঐক্য সমাবেশ’ করে। ওই সমাবেশে তারা উপস্থিত রোহিঙ্গাদের প্রতি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উত্তর রাখাইন পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। তাদের এই অভিযানকে বৈধতা দিতে তারা ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে, যে অভিযানকে তারা ‘অবিশ্বাসীদের’ বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ হিসেবে অভিহিত করে। সাম্প্রতিক সময়েও বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এই গোষ্ঠীগুলোর সহিংস কৌশলের কারণে তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করত। এরপরও আরাকান আর্মির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও প্রত্যাবাসন অধরাই থেকে যাবে– এমন শঙ্কায় আশ্রয়শিবিরকে সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সদস্য সংগ্রহের আরও উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা গোষ্ঠীদের ‘ঐক্যের’ উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। যদিও সংস্থাগুলো জোর দিয়ে বলছে, তাদের উদ্দেশ্য শিবিরগুলোতে সহিংসতা কমানো। তবে মনে হচ্ছে, তারা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার একটি উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে। তারা গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে কোনো সহায়তা দিচ্ছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এসব নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া আলোচনার সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলছে। আরাকান আর্মি এখন সেসব পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখান থেকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছিল।
আরাকান আর্মির ওপর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি সে দেশে নাগরিকত্বসহ পূর্ণ অধিকার অর্জনে তাদের সংগ্রামকে দুর্বল করে দেবে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা দেশজুড়ে তাদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে। আরাকান আর্মির বিরোধিতা করাকে মিয়ানমারের অনেকের চোখে সেনাবিরোধী সংগ্রামের ‘ভুল’ দিকে রোহিঙ্গাদের দাঁড় করাবে। এর ফলে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে, নির্যাতনের হুমকি বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত দেশটির বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপের পরামর্শ, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানো; একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তা বাড়াতে কাজ করা, যা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা আনতে পারে। ঢাকা ও তার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরও উচিত শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করা। আরাকান আর্মির উচিত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও রোহিঙ্গাদের কাছে প্রমাণ করা যে, রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে তারা শাসনকাজ চালাতে পারে এবং মতপার্থক্য নিরসনে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র তাদের বেশির ভাগ বৈদেশিক সহায়তা কমিয়ে দিচ্ছে, তাই অন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে সহায়তা বাড়ানো। -- সূত্র : ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন
আমার বার্তা/জেএইচ