সম্ভাবনা থাকলেও দাঁড়াতে পারছে না খুলনার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

সম্ভাবনা থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতায় দাঁড়াতে পারছে না খুলনা অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার তৈরির দাবি উঠছে বারবার। অথচ কর্মসংস্থান তৈরির বড় সম্ভাবনা থাকলেও সরকারি সহায়তার অভাবে অনেক উদ্যোগই থমকে আছে। তবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, উদ্যোক্তাদের জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।

অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর খুব অল্প পুঁজি নিয়ে খুলনার দৌলতপুরে বিভিন্ন পাটপণ্য তৈরির কারখানা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ছাকেরা বানু। নিজে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই কাজে প্রশিক্ষিত করেছেন অনেক নারীকেও। তবে নানা সংকটে বড় করতে পারেননি তার বিনিয়োগ। ছাকেরা বানু বলেন, ‘অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর খুব অল্প পুঁজিতে আমি পাটজাত সামগ্রী উৎপাদনের কাজ শুরু করি। নিজে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারীকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এখন ঘরোয়া পরিবেশে ব্যাগ, কার্পেট, হ্যান্ডিক্রাফটস, গয়না তৈরি করছি।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘বাজার চাহিদা আছে, কিন্তু বড় পরিসরে কাজ করার জন্য সহায়তা পাচ্ছি না। ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে জটিল শর্ত থাকে, যা ছোট উদ্যোক্তাদের পক্ষে মেনে চলা কঠিন। ফলে স্বপ্ন থাকলেও তা পূরণ হচ্ছে না। আমি চাই সরকারের পক্ষ থেকে সহজ ঋণ ও মার্কেটিং সাপোর্ট দেয়া হোক, যাতে আরও নারীরা উদ্যোক্তা হতে পারে।’
 
ছাকেরা বানুর মতো এমন শত শত উদ্যোক্তা রয়েছেন খুলনা জুড়ে। নগর ও আশপাশের উপজেলায় গড়ে উঠছে এমন ছোট ছোট নানা শিল্প। কেউ কাঠ দিয়ে তৈরি করছেন প্লেট, বাটি, রুটি মেকার, কেউ করছেন ব্যাগের ওপর নকশা, হাতের নিপুণ কারুকার্যে তৈরি করছেন জামা, ওড়না, বুটিক থ্রি পিস, প্লাস্টিকের স্যানিটারি সামগ্রী তৈরি হচ্ছে ছোট কারখানায়। বেতের তৈরি চেয়ার টেবিলেও স্বাবলম্বী হতে স্বপ্ন দেখছেন অনেকে। তবে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় বাড়ছে না বিনিয়োগ এসব শিল্পে। স্থানীয় বাজার চাহিদাও থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত স্থান না থাকা, সঠিক প্রশিক্ষণ না পাওয়া, পণ্যের প্রচারের ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় দাঁড়াতে পারছেন না ক্ষুদ্র ও মাঝারি এসব উদ্যোক্তারা।
 
শহরের তরুণ উদ্যোক্তা ফারুক হাসান জানান, ‘কাঠ দিয়ে প্লেট, বাটি, রুটি মেকার তৈরি করি। স্থানীয়ভাবে বিক্রি হয়, কিন্তু বড় বাজারে পৌঁছানো যায় না। প্রদর্শনী বা নির্দিষ্ট মার্কেট থাকলে বিক্রি বৃদ্ধি পেত। এছাড়া ঋণ নিতে গেলে জামানত চাওয়া হয়, যা আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকার যদি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে আমরা আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারব।’
 
খালিশপুরের বুটিক উদ্যোক্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘জামা, ওড়না, থ্রি-পিস তৈরি করি। স্থানীয় ক্রেতা থাকলেও বাইরের বাজারে পৌঁছাতে পারি না। অনলাইনে বিক্রি করি, কিন্তু ডেলিভারি খরচ খুব বেশি। প্রশিক্ষণ, মার্কেটিং সাপোর্ট ও সরকারি সহায়তা ছাড়া বড় হতে পারি না। আমরা চাই সরকার ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য প্রদর্শনী, প্রদর্শন কেন্দ্র এবং অনলাইন বিক্রির সহায়তা দিক।’
 
উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্প পরিবেশ তৈরি করা গেলে বাড়বে কর্মসংস্থান, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। এজন্য সরকারকেই এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের। জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি খুলনার সভাপতি মো. ইফতেখার আলী বাবু বলেন, ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা গেলে এ অঞ্চলের কর্মসংস্থান কয়েকগুণ বাড়বে। কিন্তু ব্যাংক ঋণে জটিলতা, প্রশিক্ষণের অভাব এবং পণ্যের বাজারজাতকরণ না থাকায় উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। সরকার যদি এগিয়ে আসে, তবে শুধু খুলনা নয়, দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র শিল্প বড় অবদান রাখতে পারবে। ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও বাজার সৃষ্টির সুযোগ দেয়া জরুরি।’
 
আর উদ্যোক্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণে সহায়তা করা হয় বলে দাবি বিসিকের। পণ্যের প্রচার ও নির্ধারিত স্থানের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণেরও কথা জানান তারা। বিসিক খুলনার উপমহাব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, ‘আমরা নিয়মিত উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। নতুন পরিকল্পনা নিয়েছি যাতে উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য বাজারজাত করতে পারেন। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে বিসিক শিল্পনগরীতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শুধু উদ্যোগ নেয়ায় সব সমস্যা সমাধান হবে না, উদ্যোক্তাদেরও প্রচেষ্টা এবং সরকারের সহায়তা একসঙ্গে চলতে হবে।’
 
খুলনা অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক ও নদীকেন্দ্রিক শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো শুধু স্থানীয় কর্মসংস্থানই নয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ব্যাংক ঋণের জটিলতা এবং বাজার সৃষ্টির অভাবে উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। সঠিক নীতি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ এবং নির্ধারিত মার্কেটের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলে খুলনা অঞ্চলের অর্থনীতিতে এই খাত নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারবে।
 
খুলনা বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তার নিবন্ধন রয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু নিবন্ধন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না, তাদের প্রয়োজন আরও কার্যকর সহায়তা।

আমার বার্তা/এল/এমই