ব্যাংক খাতের সংস্কার ও জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৯০ কোটি ডলার ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) পৃথক দুটি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে এডিবি।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল ও সংস্কারের জন্য ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের নীতি-ভিত্তিক ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ঋণ অনুমোদন হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলার।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও কাঠামোগত সংস্কারের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের নীতি-ভিত্তিক ঋণ অনুমোদন করেছে। এই অর্থের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক তত্ত্বাবধান, কর্পোরেট সুশাসন, সম্পদের মান এবং সামগ্রিক স্থিতিশীলতা জোরদার করা হবে।
‘ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও সংস্কার কর্মসূচি, উপ-প্রোগ্রাম ১’ মূলত ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনার কাঠামো উন্নত করতে কাজ করবে। একই সঙ্গে, ব্যাংকিং খাতে জমে থাকা অকার্যকর ঋণ মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে, যাতে আর্থিক খাতের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো যায়। ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নিয়ম মেনে চলার বিষয়েও নজর দেয়া হবে, যার ফলে সম্পদের মান নিয়ে স্বচ্ছতা আসবে।
এডিবির প্রধান আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব কৌশিক বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল সম্পদের মান, তারল্যের ঘাটতি এবং সীমিত আর্থিক মধ্যস্থতা। এর ফলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কম। এই কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাড়বে, ব্যাংকগুলোর মূলধন শক্তিশালী হবে এবং ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হবে।’
বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় কার্যকর মধ্যস্থতার অভাব রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবা পাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে। প্রচলিত ব্যাংকিংখাত মূলত শিল্প ও বড় ঋণগ্রহীতাদের ওপর কেন্দ্রীভূত, যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রেক্ষাপটে, ডিজিটাল অবকাঠামোসহ ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করা গেলে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস তৈরি হবে এবং আরও বেশি মানুষের জন্য খরচ-সাশ্রয়ী আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে এডিবির ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এই অর্থ ‘জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কর্মসূচির (সিআরআইডিপি)’ দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হবে। এতে আরও সহ-অর্থায়ন যোগ হচ্ছে ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) থেকে ১১৩ মিলিয়ন ডলার এবং এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
এডিবির সিনিয়র পাবলিক সেক্টর অর্থনীতিবিদ সমীর খাতিওয়াদা বলেন, ‘এই কর্মসূচি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে একত্রিত করে জাতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে সহায়তা করবে। এটি জলবায়ু অর্থায়নের বাধা দূর করে অভিযোজন এবং নির্গমন হ্রাসে গতি আনবে।’
সিআরআইডিপির আওতায় একটি 'বাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন অংশীদারিত্ব' গঠিত হবে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও অর্থায়নে সক্ষমতা দেবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে অভিযোজন ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। ফসল বীমা, দুর্যোগ ঝুঁকি বীমা ও জরুরি অর্থ সহায়তার মতো উদ্যোগকেও গুরুত্ব দেয়া হবে।
এছাড়া ঢাকার কৌশলগত পরিবহন মাস্টারপ্ল্যান (২০২৫-২০৩৪) হালনাগাদ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণে বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে কর্মসূচিটি। এর মাধ্যমে টেকসই পরিবহন ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থার বিকাশে গতি আসবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কার্বন নির্গমন উচ্চ হারে চলতে থাকে, তবে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপি এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে পারে। বর্তমানে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে, যা জিডিপির ০.৭ শতাংশ। তীব্র বন্যার কারণে ২০৫০ সালের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। সেই সময়ের মধ্যে দেশের ১৭ শতাংশ ভূমি এবং ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে।
এই কর্মসূচি জলবায়ু অর্থায়নের অভাব, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন প্রচেষ্টায় সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলবে।
উল্লেখ্য,এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি শীর্ষস্থানীয় বহুপাক্ষিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল ও টেকসই প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করে। অঞ্চলটির জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এডিবি তার সদস্য ও অংশীদারদের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে। লক্ষ্য-জীবনের মানোন্নয়ন, উন্নত অবকাঠামো গঠন এবং পরিবেশ রক্ষা।
উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এডিবি উদ্ভাবনী আর্থিক সরঞ্জাম ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব ব্যবহার করে। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এডিবির বর্তমানে ৬৯টি সদস্য রয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি সদস্যই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের।
আমার বার্তা/এল/এমই