আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা) পাচার হওয়ার তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এসব অর্থ উদ্ধারে বিদেশিদের কাছে সাহায্য পাচ্ছি। যারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করেছে, তাদের অনেকের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের (বিএফআইইউ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন গভর্নর। এসময় বিএফআইইউ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিতর্কিত থার্মেক্স গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই প্রতিবেদন দিয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ এই খেলাপি গ্রহিতার বিরুদ্ধে পরবর্তি প্রক্রিয়ায় যাওয়া হবে। বিগত দুই গভর্নর ফজলে কবির ও আবদুর রউফ তালুকদারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় থার্মেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছে বলে অভিযোগ, যা অনুসন্ধান করছে বিএফআইইউ। বর্তমানে কাদির মোল্লার সকল ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে রেখেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে, এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন। আমরা কেউ এ ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ গতিশীল করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সে জন্য আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। ইতিমধ্যে বিদেশে একজনের সম্পদ জব্দ হয়েছে। সামনে আরও সম্পদ জব্দ হবে। আমাদের উদ্দেশ্য, পাচারকারীদের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে আদালতের বাইরে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করা যায়। কাউকে জেলে নিয়ে হয়রানি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারও ব্যবসা বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কারও ব্যবসা বন্ধ করিনি। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, অন্য কারণে তা হয়েছে।
অর্থপাচার ছাড়াও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রসঙ্গেও কথা বলেন তিনি। গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। এতে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত থাকবে। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমানতকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ তারা একটি শক্তিশালী ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। বর্তমানেও গ্রাহকের টাকা সুরক্ষিত রয়েছে মন্তব্য করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন না করার আহ্বান জানান তিনি। একীভূতকরণের আগে ব্যাংক রেজল্যুশন ফান্ড গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিল সংগ্রহ করবে বলেও জানান গভর্নর। তার কথায়, ব্যাংক রেজুলেশন আইনের মধ্যে থেকেই ব্যাংক একীভূত করা হবে। তাতে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা এর একদিন আগেই বলেছেন গভর্নর আহসান মনসুর। চলতি বছর জুলাইয়ের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষে একীভূত ব্যাংকের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে বলে সোমবার জানিয়েছিলেন গভর্নর।
সভায় জানানো হয়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএফআইইউতে মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল হয়েছে; আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার ও হুন্ডি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে পরামর্শ ও সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বিএফআইইউর প্রধান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে সংস্থাটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, তদন্তকারী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের এসটিএআর, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডোজ, আইএসিসিসি ও আইসিএআরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ায় সময় লাগবে।
সভায় বিএফআইইউর পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, অর্থ পাচার ধরা ও উদ্ধার করা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকবে। গত বছরের জুলাই মাসের পর বিএফআইইউর কাজ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সন্দেহজনক প্রতিবেদন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পাঠানো চার গুণ বেড়েছে। গতকালের সভায় থার্মেক্স গ্রুপের ব্যাংক লুটের প্রসঙ্গ আসলে বিএফআইইউ’র পরিচালক মোস্তাকুর রহমান বলেন, থার্মেক্স গ্রুপের অর্থ পাচারের বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলমান আছে। কাজ শেষ পার্যায়ে। আমরা আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই থার্মেক্স গ্রুপের অর্থ পাচারের তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে।
আমার বার্তা/এমই