জাবিতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

  প্রতিনিধি জাবি:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৫ অক্টোবর সিন্ডিকেট সভায় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে ৩জন, পাবলিক হেলথ্ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে ২জন, আইন বিভাগে ৩ জন, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।

এরই মধ্যে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে নতুন করে তিনজন শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আজ ১ ডিসেম্বর নিয়োগ বোর্ড বসবে। প্রার্থীদের মধ্যে একজন শিক্ষকের স্ত্রী রয়েছেন বলে জানা যায়।

উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় শ্রেণি (সেকেন্ড ক্লাস) থাকা এবং দীর্ঘদিন শিক্ষাকার্যক্রমে সম্পৃক্ত না থাকা স্বত্বেও তাকে নিয়োগের বিষয়ে ব্যাপক তদবির চলছে বলে জানা গেছে। নিয়োগের নিশ্চিতের জন্য প্রার্থীদের থেকে ২৫ লক্ষ টাকা দাবি করেছে একটি চক্র এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা যায়, পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে তদবির ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যদের বাদ দিয়ে প্রশাসনের অনুগতদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়ারও। 

পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রয়োজন না থাকলেও শুধু নিজের পছন্দের জন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে বিভাগের সাবেক সভাপতি ও জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নুহু আলমের বিরুদ্ধে। বিভাগের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য না মেনে এবং সভাপতির একক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দুইজন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামীমা নাসরীন জলি বলেন, 'নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত বিজ্ঞপ্তিতে ব্রাঞ্চ বা ডিসিপ্লিন উল্লেখ করা হয়। এটা আমাদের বিভাগের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। একাডেমিক মিটিংয়ে কোন কোর্সে লোড বেশি তা বিবেচনা করে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।

এটা আামদের বিভাগের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। আমাদের নিয়োগও ব্রাঞ্চ ভিত্তিতে হয়েছে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর ব্রাঞ্চ  উল্লেখ না করে সার্কুলার প্রকাশের পর বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকগণ তৎকালীন সভাপতিকে নিয়ে বসেন।

তখন তিনি সার্কুলারে ব্রাঞ্চের কথা উল্লেখ করে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য উপাচার্য মহোদয়কে অনুরোধ করবেন বলে কথা দেন। এটি রেজ্যুলেশন আকারে পাশও হয়। কিন্তু তা না করেই সভার নয় মাস পরে হঠাৎ করেই নিয়োগ বোর্ডের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

তখন আমরা বিভাগের শিক্ষকরা মিলে ভিসি স্যারের সাথে দেখা করি। তিনি কোর্স লোড বিবেচনা করে যে কোর্সে শিক্ষক কম সেই কোর্সে  যোগ্যদের নিয়োগ দিবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু তা পরবর্তীতে রক্ষা করা হয়নি।'

খোঁজ নিয়ে জানা যায় গত ৫ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে দুইজন অস্থায়ী প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।  সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভাষকরা হলেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারহানা রহমান এবং ৩২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শামিমা আক্তার নূপুর।
 
এর মধ্যে ফারহানা রহমান স্নাতকে (সম্মান) প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় ও স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। কিন্তু তার পাশ করার ১৬ বছরেও কোন পিএইচডি ডিগ্রি নেই।

অপরদিকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম,  গোল্ড মেডেলিস্ট ও পিএইচডি ধারী প্রার্থী থাকা স্বত্বেও তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্তরা অধ্যাপক নূহু আলমের থিসিসের শিক্ষার্থী ছিলেন। শিক্ষক সংকট না থাকা স্বত্বেও বিভাগের সভাপতি থাকা অবস্থায় ফারহানাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য  ব্যাপক চেষ্টা চলান তিনি।

এমন ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ হলে এর বিরূপ প্রভাব শিক্ষার্থীদের বহন করতে হবে বলে মন্তব্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ছালেহ আহাম্মদ খান বলেন, 'আমাদের বিভাগে বর্তমানে ৮টা সিডিপ্লিন আছে এবং আমরা মোট ২২ জন শিক্ষক। এর মধ্যে প্ল্যান্ট প্যাথলজি ডিসিপ্লিনে ৪জন শিক্ষক আছেন যা অন্য ডিসিপ্লিনগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি।

এমন অবস্থায় সেই ডিসিপ্লিনে নতুন করে আরেকজন শিক্ষক নিয়োগের কোন যৌক্তিকতা নেই। তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতি চলমান ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে একক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এরককম বিজ্ঞপ্তির পর বিভাগের ১৮ জন শিক্ষক পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আবেদন জানায়। এবং ১১ জন শিক্ষক উপাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে সার্বিক বিষয় তুলে ধরেন।  উপাচার্য ডিসিপ্লিনের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিবেন বলে আশ্বাস দিলেও তা পূরণ করেন নি।

তবে যথাযথ নিয়ম মেনে বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করে তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক নূহু আলমমের বলেন, 'নিয়োগ বোর্ডে বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি থেকেও প্রার্থীদের কাউকে কোন প্রশ্ন করিনি।  কারোর জন্য বিশেষ সুপারিশ করি নি।'

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নিদিষ্ট ব্রাঞ্চের কথা উল্লেখ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিভাগে ৮টি ব্রাঞ্চ  আছে এটা মিথ্যা কথা। আমাদের ৮টা ল্যাব আছে। আর শিক্ষক নিয়োগ হয় বোটানির, কোন ল্যাব উল্লেখ থাকে না।

আর আগে সব ভালো শিক্ষার্থীরা মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবের ছিলো সেজন্য সে ল্যাব থেকে শিক্ষক সংখ্যাও বেশি। কিন্তু বর্তমানে ভালো শিক্ষার্থীরা প্ল্যান্ট প্যাথলজি ল্যাবে আসছে। সেজন্য তাদের রেজাল্টও ভালো৷ আর বোটানি থেকে অনার্স মাস্টার্স করা যে কেউই বোটানির যেকোন কোর্স পড়াতে পারে।'

এদিকে একই সিন্ডিকেটে প্রভাষক পদে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে নিয়োগ বিভাগের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আনিকা বুশরা বৈচি।

নিয়োগের পর গত ২৩ নভেম্বর তারিখে মাহমুদুর রহমান জনির সাথে সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচির অন্তরঙ্গ ছবি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও পয়েন্টে পোস্টারিং করতে দেখা গেছে।

ছবিতে আনিকা বুশরা বৈচিকে মাহমুদর রহমান জনির অফিস কক্ষে ললিপপ হাতে নিয়ে তার উরুতে বসার ভঙ্গিতে সেলফি তুলতে দেখা গেছে। ছবির শিরোনামে ‘এভাবেই ললিপপের ভেলকিতে শিক্ষিকা হলেন অনিকা বুশরা বৈচি’ উল্লেখ করা হয়েছে৷

এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে চাকুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও শারিরীক সম্পর্কের পর জোরপূর্বক গর্ভাপাত করানোর প্রমাণ রয়েছে। ছাত্রীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে করা কথোপকথনের অডিও রেকর্ড থেকে এর সত্যতা মিলে।

এদিকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, 'প্রভাবশালী এক শিক্ষকের স্ত্রীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য তোড়জোড় চলছে এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাকার্যক্রমের বাইরে আছেন।

এছাড়াও তার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ৷ এরকম প্রশ্নবিদ্ধ কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলে সার্বিকভাবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অসম্মানজনক  হবে। ফলে বিভাগগুলোকে এর নেতিবাচক ফল দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হবে।'

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিয়োগে তদবির ও ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি সংসদ। বিবৃতিতে দুই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ  শিক্ষক নিয়োগে কেলেঙ্কারির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি করেছেন।

এবি/ওজি