ভিন্নচিন্তা

মনুষ্যত্ব-হত্যার বিচার হওয়া উচিত

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২২, ১৪:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

  নওরীন নুসরাত স্নিগ্ধা :

পৃথিবী মনুষ্যত্বের দোলনা, কিন্তু মানবজাতি চিরকাল সেই দোলনায় থাকতে পারে না। কথাটি বলেছিলেন একজন উজ্জ্বল বিজ্ঞানী কনস্ট্যান্টিন সিওলকোভস্কি, যিনি রাশিয়ান দ্যা ভিঞ্চি হিসেবেও বিশেষ সমাদৃত। তার এই উক্তি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, মানুষ মাত্রই মনুষ্যত্বসম্পন্ন হবে, কিন্তু সেই মনুষ্যত্ব বজায় রাখা ঢের কঠিন। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব কেবল কাঠিন্যের দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত যেভাবে মনুষ্যত্বকে গলা টিপে হত্যা করছে সেটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

সাধারণত নাক মুখ চোখ কান থাকলেই মানুষ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়, কিন্তু মনুষ্যত্ব বলতে বোঝায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সাধারণ গুণাবলী। মানবপ্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, পরোপকারিতা, সততা, বিশ্বস্ততা, বিনয়, নম্রতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ত্যাগ যার অত্যাবশকীয় উপাদানসমূহ। কিন্তু আমাদের মধ্যে কজন এই গুণাবলী গুলো ধারণ করি? চর্চাই বা করি কজন? বরং দিন দিন আমরা হয়ে উঠছি চরম স্বার্থবাদী, উগ্র, উশৃঙ্খল, অসহিষ্ণু, আত্মকেন্দ্রিক ও হিংসাপরায়ণ।

বিভিন্ন পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালগুলো খুললেই চোখে পড়ে মানুষ পিটিয়ে হত্যা, চোখ উপড়ে ফেলা, মিথ্যা সন্দেহে হাতের কব্জি কেটে ফেলা, মাদকাসক্ত সন্তানের মাকে গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস সব ঘটনা, যেগুলো চোখে পড়লেই গা শিউরে ওঠে। অথচ ঘটনাগুলোর নিত্যনৈমিত্তিকতা মানুষের গা সহা হয়ে যাওয়ার পায়তাড়া করছে। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর চুরির অপবাদে শিশু রাজন-রাকিব হত্যা, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ তনুর ধর্ষণ ও হত্যা, ২০১৯ সালের ২০ জুলাই ছেলেধরা সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে রেনু হত্যা, একই বছর ১০ এপ্রিল  মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, ২০২০-২১ সালে কোভিডকালীন সময়ে নিজ স্বজনের লাশ ফেলে পালিয়ে যাওয়া, সম্প্রতি ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শিশু সন্তানের সামনে গৃহবধূ রাজিয়াকে পিটিয়ে হত্যা, চার বছরের শিশুকে মাসের পর মাস যৌন নির্যাতন করা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এজন্যই হয়তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলে গিয়েছিলেন, "আমি মানুষের মৃত্যুতে দুঃখ পাই না মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে দুঃখ পাই। তার সময়ে মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়তো অনাকাক্সিক্ষত ছিলো, তাই তিনি দুঃখ করে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়েই আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব হত্যা করছি। এতে আমরা দুঃখ পাই না, অনুতপ্তও হই না, বরং পাশবিক আচরণে আরো একধাপ এগিয়ে যাই। অমানবিকতায় হই উদ্বুদ্ধ। মনুষ্যত্বের যে মৃত্যু ঘটছে সেটি আরো প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয়, যখন অন্যের দুঃখ-কষ্ট-অসহায়ত্ব আমাদের স্পর্শ করতে পারে না।  কোনো দুর্ঘটনায় এগিয়ে না গিয়ে, কারো বিপদে সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে নির্বিকার দর্শকের মতো তা উপভোগ করি, কখনো আবার মুঠোফোন বের করে ভিডিওচিত্র গ্রহণ করি। বন্যা-দুর্যোগ কবলিত দুঃস্থদের সেবার নামে যখন সস্তা জনপ্রিয়তার খোঁজ করি, ত্রাণ-যাকাতের নাম ভাঙ্গিয়ে যখন মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যস্ত থাকি তখন বুঝে নিতে হবে আমরা খুনী, খুন করেছি নিজেদের মনুষ্যত্ব আর নিজেদের বানিয়ে রেখেছি মানুষ নামের এক অকেজো যন্ত্র। কিন্তু এতে চিন্তার বিশেষ কারণ নেই। কেননা এর কোনো বিচার হয় না, কোনো শাস্তিও পেতে হয়না। বরং এভাবে মিথ্যা প্রশংসা কুড়ানোই এখন জনপ্রিয় ‘সোশ্যাল প্র্যাক্টিস’।

অন্যদিকে মনুষ্যত্বের মাথা খেয়ে বসে থাকা আমরা দেশে দিনদিন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়িয়েই যাচ্ছি। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার অপরাধে নিজের সন্তানদের কাছে যখন  বাবা-মাকে বোঝা হয়ে যেতে হয়, তখন কোনো আশ্রমকেই কি আর ‘আশ্রয়’ হিসেবে ব্যক্ত করা যায়? অথচ এই বাবা-মা আমাদের একটু সুখে রাখার জন্য কত ত্যাগ-তিতিক্ষা করেন সে হিসেব আমি-আপনি কজন রাখি? এই আমার কথাই বলা যাক। সন্তানের জন্য সর্বদা নিবেদিত প্রাণ যে বাবা-মায়ের শেষ বয়সে এসে প্রতিদানস্বরূপ তাদেরই কেনো বৃদ্ধাশ্রম মেলে? মনুষ্যত্বকে কতটা নির্মমভাবে হত্যা করলে সেই সন্তানেরা এমন অমানবিক কাজ করতে পারে কারো জানা আছে?

মনুষ্যত্ব হত্যার অন্যতম এক কলঙ্কিত নজির ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’।  'কলঙ্কিত' বলার কারণ ব্যখ্যা করছি। মা-বাবার ভরণ- পোষণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সঙ্গে সন্তানের বসবাস বাধ্যতামূলক করার বিধান করে সরকার ২০১৩ সালে এই আইন পাস করে।

এই আইনের, ৩ ধারায় বলা হয়, প্রত্যেক সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে।

৩ ধারায় আরো বলা হয়, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তার বা ক্ষেত্রমতো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে।

মনুষ্যত্ব চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে নৈতিকতার বাণী ছড়াতে হবে, সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতা চর্চা, ধর্মশিক্ষার চর্চা বাড়াতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে মনুষ্যত্ব পরিপন্থী যেকোনো কাজের বিরুদ্ধে সমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে। তবেই তো বাঁচবে মানুষ আর অমর হবে মনুষ্যত্ব..

আইন অমান্যকারীর বিচার প্রসঙ্গে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী কোনো সন্তান এই আইন লঙ্ঘন করলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, স্বামী, তাঁদের পুত্র-কন্যা কিংবা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে উক্ত আইনের ধারা ৫(২) অনুযায়ী তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে, ফলে তারাও একই শাস্তির মুখোমুখি হবে। এছাড়াও ২০২১ সালে পিতা মাতার ভরণপোষণ বিধিমালা পাশ হয়। যেখানে বাবা-মায়ের খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান, সঙ্গ এমনকি মৃত্যুকালে করণীয় বিষয়সমূহ বিধি আকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যে দেশে পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হয় আইন প্রণয়নের দ্বারা, যেখানে বাবা-মায়ের প্রতি এমন অবিচারের শাস্তি মাত্র এক লাখ টাকা, সে দেশের মানুষগুলো কতটা নৃশংসভাবে নিজেদের মনুষ্যত্ব হত্যা করে নির্বিকারভাবে জীবন যাপন করছে সেটি হয়তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবে চলতে থাকলে পুরো বিশ্ব শীঘ্রই মগের মুল্লুকে পরিণত হবে। তাই সময় থাকতেই লাগাম টেনে ধরতে হবে। মনুষ্যত্ব পুনরিজ্জীবিত করার সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। আর সমাধান খুঁজতে যেতে হবে সমস্যার মূলে। আর এই মূল সমস্যা নিয়ে কথা বলে গিয়েছেন লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী। তিনি তাঁর ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষের মাঝে দুটি সত্তা রয়েছে। একটি জীবসত্তা আরেকটি মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই জীবসত্তা থেকে একজন মানুষ মানবসত্তায় উপনীত হয়।’

কিন্তু শিক্ষিত হয়েও কি আমরা মানবসত্তা অর্জন করতে পারছি? পারছি না, কারণ আমরা কেবল সনদমুখী শিক্ষা অর্জন করছি, বাস্তব গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা হারিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। পাঠ্যক্রমসূচিতে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা নেই, পরিবারগুলোতে নৈতিকতা-মানবিকতার চর্চা নেই, সঠিক জ্ঞান আহরণের চেষ্টা নেই। আছে কেবল শিক্ষার হার বাড়ানোর চেষ্টা, শিক্ষার মান বাড়ানোর নয়।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী আরো বলেছিলেন, ‘মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি প্রয়োজন।’ অথচ আমরা হন্যে হয়ে ছুটি অর্থ উপার্জনের জন্য, বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য। তাই টাকার বিনিময়ে মনুষ্যত্ব খুইয়ে অন্যায়,অবিচার, দুর্নীতি করতে আমরা দুবার ভাববার প্রয়োজন বোধ করিনা।

অন্য একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ধর্মভীরুতার অভাব। পৃথিবীতে বসবাসকারী সব মানুষই কোনো না কোনো ধর্মাবলম্বী। প্রত্যেক ধর্মই শান্তির কথা বলে, মানবিকতার কথা বলে, মনুষ্যত্বের কথা বলে। কিন্তু সেসব বাণী অগ্রাহ্য করে আমরা ছুটে চলেছি আপন মনে। স্রষ্টার ভয় নেই, শাস্তির ভয় নেই, এখন আর আমাদের রুখবে কে?
রুখতে হবে নিজেদেরকেই। কেননা,আইন প্রণয়ন করে কেবল অপরাধ দমন করা যায়, অপরাধের শাস্তি বিধান করা যায়। কিন্তু অপরাধপ্রবণ মন (আইনের ভাষায় সবহং ৎবধ)কে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয় নিজেকেই। নিজের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বসবাসের যোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলেতে হলে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো অপরিহার্য। আর তাই এই প্রতিকূল অবস্থায়ও যে মুষ্টিমেয় মানুষগুলো এখন পর্যন্ত মনুষ্যত্ব বজায় রেখেছেন এই সংকটাপন্ন সময়ে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে, মনুষ্যত্ব চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে নৈতিকতার বাণী ছড়াতে হবে, সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতা চর্চা, ধর্মশিক্ষার চর্চা বাড়াতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে মনুষ্যত্ব পরিপন্থী যেকোনো কাজের বিরুদ্ধে সমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে। তবেই তো বাঁচবে মানুষ আর অমর হবে মনুষ্যত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ল’ এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]